কি এবং কী -এর পার্থক্যে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা একাডেমি কেন ভুল By ডা. অপূর্ব চৌধুরী, London, England


কি’ বা ‘কী’ – দুটোই প্রশ্নবোধক শব্দ । কোনো প্রশ্ন করতে শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয় ।

যদি কোনো প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ অথবা না এমন কিছু আসে, সেখানে ‘কি’ ব্যবহার করতে হবে ।

যদি কোনো প্রশ্নের উত্তরে শুধু হ্যাঁ অথবা না এর পরিবর্তে একটা কিছু উত্তর আসে, সেখানে ‘কী’ ব্যবহার করতে হবে ।

উদাহরণ –

ধরুন, আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলো –

তুমি কি খাবে ?

– মানে হলো – আমি খাবো কিনা সেটা জানতে চাইছে । উত্তর – হ্যাঁ অথবা না । তাহলে এখানে ‘কি’ শব্দ বসবে ।

আবার ধরুন, কেউ জানতে চাইলো আমার কাছে-

তুমি কী খাবে ?

– মানে হলো আমি কোন খাবারটি খাবো বা আমার খাবার মেনুটির নাম । উত্তরে আমি হয়তো বললাম – আমি চা খাবো । তারমানে এখানে ‘কী’ এর উত্তরে একটা কিছু উত্তর আছে, চা খাবো । উত্তর কেবল হ্যাঁ কিংবা না নয় । তাহলে এখানে ‘কী’ বসবে ।

আমি সবসময় এটা মানি না । আমি আগে থেকেই এটা জানি, কিন্তু মানি না । মাঝে মাঝে মানি ।

কেনো মানি না, এটা বলছি । এমনকি আমি দেশের অনেক জাতীয় পত্রিকাতেই লিখি । সি ক্যাটাগরির সাংবাদিকরা আমার লেখায় অন্য কোনো শব্দের কাঁচি বসাতে না পারলেও এই কি এবং কী শব্দে কাঁচি বসিয়ে পাকামো দেখায় । আমি তারপরেও মূল লেখায় ইচ্ছা করে সংশোধন করি না । ভাষাকে সহজ করতে সব কি দিয়েই লিখি । কী আমি পরিহার করি । কোনো প্রয়োজন মনে করি না । ভাষার লতা পাতা যত কমিয়ে সহজ করা যায়, তত ভালো ।

আমার জানা মতে কিছু বিজ্ঞ ব্যাক্তি আমার মতই কি এবং কী এর তেমন পার্থক্য করে না, শুধু কি ব্যবহার করেন । এদের মধ্যে ড. সলিমুল্লাহ খান একজন । তিনিও যতদূর জানি কি এবং কী এর পার্থক্যের বিরোধী ।

কেনো আমি মনে করি – ‘কি’ এবং ‘কী’ যেমন সঠিক, তেমনি সব শব্দে ‘কি’ শব্দটাও সঠিক । শুধু শুধু আরেকটা কী লিস্টে বাড়ানোর দরকার নেই ।

কারণ বলছি ।

‘কি’ এবং ‘কী’ -এর এই পার্থক্য প্রথম ব্যবহার চালু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । বিশ শতকের শুরুতে । অনেকের মতে আমার সোনার বাংলা যা আমাদের জাতীয় সংগীত এখন, সেখানে তিনি প্রথম ‘কি’ এবং ‘কী’ ব্যবহার করেন । রবীন্দ্র ব্যবহারে এটি আস্তে আস্তে জুড়ে বসে বাংলা ভাষায় ।

রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেছেন বলেই ভাষার সবকিছু ঠিক হবে, এটা ঠিক নয় । বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথের একার নয় । আবার রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটা পুরোপুরি শুদ্ধ নয় । আংশিক শুদ্ধ ।

তুমি কি খাবে ? এখানে ‘কি’ হবার কারণ হ্যাঁ অথবা না এর প্রশ্ন বলে ।

তুমি কী খাবে ? এখানে ‘কী’ হবার কারণ শুধু হা বা না নয়, তার বাহিরে আরেকটি উত্তর আছে বলে ।

কিন্তু ‘কি’ এবং ‘কী’ শব্দ দুটো আলাদা করে উচ্চারণ করলে ইষৎ পরিবর্তন মাত্র । ‘কি’ উচ্চারণে ছোট করে কি ই এবং ‘কী’ উচ্চারণে একটু বেশি কি ই ই । এই যা ।

কিন্তু বাক্যের আসল পার্থক্য কিন্তু ‘কি’ বা ‘কী’ দিয়ে হয় না । বরং বাক্যটি কিভাবে পড়ছেন বা উচ্চারণ করছেন, সেটা দিয়েই পার্থক্য হয় । কিভাবে হয় দেখাচ্ছি ।

তুমি কি খাবে ? এখানে বাক্যটির উচ্চারণ হবে

তুমি কি …. খাবে ?

‘তুমি কি’ … একটানে বলার পর একটু থেমে .. ‘খাবে’ …বলা । এমন করে জিজ্ঞেস করলে তখন শ্রোতা বা বক্তা দুজনেই বুঝে যে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে যে আমি কি খাবো নাকি খাবো না ।

আবার

তুমি কী খাবে? এটাকে বলা হয়

তুমি … কি খাবে?

এখানে ‘তুমি’… প্রথমে বলার পর একটু থেমে ‘কি খাবে’… একসাথে বলা । তখন বক্তা অথবা শ্রোতা বুঝতে পারে যে জিজ্ঞেস করছে আমি কোন খাবারটি খাবো ।

তাহলে দেখলাম, ধ্বনিগত দিক থেকে বাক্যে শব্দগুলো কিভাবে বলছি সেটার উপর নির্ভর করে কোন অর্থ মিন করছি । বানানের উপর এখানে অর্থ বা উত্তর মোটেও নির্ভর করে না । এখানে ‘কি’ আর ‘কী’ এর কোনো পার্থক্য কাজ করে না । দু ক্ষেত্রেই কি দিলেও অর্থের তারতম্য করে কিভাবে বাক্যটি বলছি তার উপর । শব্দ দুটোর বানানের উপর নয় ।

রবীন্দ্রনাথ ধ্বনির এই পার্থক্য বা বাক্যে প্রয়োগের ব্যাপারটি সামনে না নিয়ে এনে বানানের ব্যাপারটি সামনে এনে একটিকে ব্যাখ্যার উপযুক্ত ভেবেছেন । এই কারণে রবীন্দ্র ব্যাখ্যা পুরোপুরি ঠিক নয়, আবার ভুলও নয় । আংশিক সঠিক মাত্র ।

তাই কেউ যদি দু’ ক্ষেত্রেই শুধু কি দিয়ে লিখে, মোটেও ভুল নয় বাক্যে উচ্চারণের দিক থেকে । বরং প্রয়োগের এবং ব্যবহারের দিক থেকে রবীন্দ্র যুক্তির চেয়ে ধ্বনির বা বাক্যে উচ্চারণের যুক্তি আরও বেশি সঠিক ।

ঠিক এই কারণেই আমি ‘কি’ এবং ‘কী’ সব সময় মানি না ।



March 25th, 2022